ইনবক্সে লেখা > দীর্ঘকবিতা >> সরোজ মোস্তফা
প্রকাশঃ June 22, 2017

এই হচ্ছে আত্মশিহরণ
মীন-মানুষের, ধান-মানুষের জন্মলজ্জা।
দাড়িকানা মাছ ইনবক্সে লেখে বংশকাহিনি
দানব মাছের ঠোঁট দেহ সবটা গিলতে পারেনি।
বাকি দেহটায় অবরুদ্ধ পথ সে একাই পেরুবে
অনেক আদর সে একাই কুড়বে।
বাদুরের ঝুলন্ত প্রহরে মেঘস্নিগ্ধ গ্রামগুলো আমাদের জন্মস্থান।
হাওরে সাগরে সব কৈর্বত সন্তান।
মেঘবিকশিত নদীটায় পূর্ণতর জলের মাস্তান।
অতৃপ্ত থাকিনি।
জলমানবেরা দেহ সঞ্চালনে ভীষণ পবিত্র।
রক্তে রক্তে পৌরাণিক ছায়াজাল
কাঠের পিঁড়িতে বসে শালিক পাখির ঠোঁটে গ্রাম দক্ষিণার মনসামঙ্গল।
সেবা ও সাধুসঙ্গের বকুল গাছেরা দূর করেছে অভাব!
ভাতের অভাব নয় মনের অভাব।
জানি, কখনো পাবো না আতর দানির আহ্লাদ!
ধর্মগায়িকারা মার্জিত মহলে দেবেন না ঠাঁই।
জাম্বুরা ফুলের পাশে তোমাদের মন ততটা বুঝিনি
যতটা বুঝেছি ঘাট-পারাপার, মৎস শিহরণ।
ঋতু বিকালের মঙ্গল ধ্বনিকে
ধূপ-মাখা পবিত্রতাসহ
ঘরে ঘরে পাঠিয়ে দিয়েছি।
কৈবর্ত সন্তান কাবা শরিফের স্নেহচোখ
নেপালি গির্জার শান্তি ফড়িং।
কৈবর্ত সন্তান রক্তে রক্তে চর্যার হরিণ।
পৃথিবীকে কিছু না দিতে পারলে
পাতাবাহার হয়ে জন্মাবে।
না হলে বিষ খেয়ে জলে নামবে
হবে, গজার মাছের পবিত্র আহার।
বৈশাখ একটা হত্যাঋতু, কালো ক্যাকটাস।
হাওরকে তলিয়ে দিয়েছে মেঘের বিন্যাস।
এ বছর ফসল হয়নি
এ বছর আমরা কি তেলাপোকা হয়ে যাবো!
এ বছর আমরা কি সুদখোর মহাজন ব্যাপারির
ক্যাশবাক্সের তলায় ঘুমিয়ে থাকবো।
ক্ষুদ্রঋণে অভিশাপে নিজের মুখটা মৃত গন্ধরাজ হলুদ পাঁপড়ি।
সময়টা বিষ মাখানো জল্লাদখানা।
নিজের মুখটা চূরমার হয়ে যায়।
এ বছর কলমিলতার পাতা খেয়ে পানিতে ভাসবো।
মগডালে ব্যথাপাখিটার সাথে ত্রাণ নিতে ভালো লাগে না দয়াল।
ত্রাণের ঘোড়ারা সেলফি তুলতে চায়!
খাকি খামের ভেতরে একহাজার টাকার নোট,
ডাল-চালের একটা প্যাকেট তুলে দিয়ে ওরা যে ছবিটা তুলে
সে ছবিটা আমাদের ক্রীতদাস করে রাখে।
নয়নতারা ফুলের লাজুক হাসিতে ত্রাণ নিয়ে ফিরি।
ত্রাণের খাবার গলায় ঢুকে না বাবু!
লজ্জার লাল খাবার গলায় ঢুকেনা বাবু!
হিজল গাছের করুণ ছায়ায় বসে থাকে কেউ,
ভেসে যায় কেউ আইপিএলের জুয়ায়।
হাওরে, নায়েব বাবুর আনাগোনা
ভ্যাট ও ভোটের টাকাগোনা।
ঘুমন্ত পাহাড় ছাড়া
শীত জোনাকির রাস্তা ছাড়া
কে শুনবে মানুষের কান্না!
বুদ্ধের মূর্তিতে চুপ করে আছে গেরুয়া সন্ন্যাসী।
পৃথিবী ছেড়ে পালায় খলিশা মাছের চোখ।
চন্দ্রহরিণের সাথে পালাতে পালাতে
জলে ভাসা মানুষেরা মুখস্ত করেছে হাঁসের চেহারা।
এই গোলাপ দেখানো রাষ্ট্রে
কাঁচের বোতলে রূপ পালটাতে পালটাতে
মানুষ হাঁসের চেহারা নিয়েছে।
মানুষ ক্রমশ ভোটের জনতা হয়ে গেছে।
চুমুর বিকালে বার্গার আয়েশে
খুশি হয় গোলাপ সমাজ।
এ সমাজে ফরিয়াদ নেই!
এ সমাজে সোনার লাইসেন্স নেই।
এ সমাজে হাসপাতালে শুয়ে আছে মায়ের শালদুধ।
জলের তলায় জল
ফসলের প্রতিচ্ছায়া।
জলের জ্ঞাতিরা
সস্তা দরে গরু বিক্রি করে।
ভিটে-মাটি ধরে রাখতে রাখতে
একদিন নিজেকেও বিক্রি করে।
খোরাকির ঘাটতি পুরণ না হলে
ছোট্ট পুটলিতে
নিজেকেও পেঁচিয়ে
একটা টি-স্টলে ঝিমুতে থাকে।
গরু ভর্তি ট্রাক ও পিকআপ
চালান করছে সাদা পাঞ্জাবির সামাজিক লোক।
হ্যাজাক লাইটের আলোতে
জীবনটা একদিন সহনীয় হয়ে যায়।
মুখের প্রস্থান কিংবা আগমন সহনীয় হয়ে যায়।
বাড়ির নামার ছাতিম গাছের সাথে নড়ে
এক বছরের আহার ভাবনা।
মহিষের সিংয়ের মতো গাঢ় কালো মেঘ বাড়িটা ভাসাবে!
একবার তলিয়ে যাওয়া বাদাম ক্ষেতের দিকে
আর একবার মেঘের উড়ন্ত হৃদয়টা দেখে পাড়ার কিশোরী।
গ্রামটাকে মনে হয় আতরহীন কবর।
হাওরের ডুবা-ফসলের কূল-কিনারা হবে না।
ঢেউয়ের ধাক্কায় উলটে থাকা হাঁসগুলো নিয়ে
মেয়েকে একটা আখ্যান শোনাবে হাঁস খামারির বউ।
জলের উপরে টনকে টন মাছের ভাসমান সাদা দেহ দেখে
স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী কথা বলবেন। কিন্তু মসজিদের ইমাম
কিংবা ভোটের মেম্বার কেউ শোকের জগতে ঢুকতে পারবেন না।
প্রমিত দোয়েল তাই পুরাতন কথা বলে।
বজ্রপাতে গোনাগার গাছগুলো
গ্রাম সর্দারের লাঠিটার দিকে নত হতে হতে বলে, ‘এখানেই শেষ।
এখানেই সবুজ মনের সমাপ্তি।’
গোলাকার মালটার অনুরোধ
কিংবা চাল ও ডালের অনিবার্য ঘ্রাণ
মানুষকে পথিক বানায়।
মাঝখানে রিলিফে ও শোকে
ভিআইপি লোকেরা খুব হাততালি পায়!
লাল হরিণের পা গুলোকে খুলে দিলে
একটার পর একটা জংশন পেরুবে।
জলপাই গাছের গুড়িতে গ্রামসর্দারের আদালত
যন্ত্রণা পলাশে নীরিহ হরিণ চামরার ভেতরে কাঁদে!
বুলেট-ছুরির টর্চার সেলে
নিম গাছের ছায়ায় জননীর পা ধরে কাঁদে!
ঘরে ভাত না থাকলে কী করবে
রাষ্ট্রের ময়ূর!
কাঁধে নিয়ে বাঁচার অভ্যাস
কালো মানুষের চোখ
ভাতের ডেকচি উলটায়।
উদোম হাড়িতে দুপুরের জ্ঞান।
উদোম হাড়িতে মা-নারীর অপমান!
রান্না ঘরের কপাটে দুপুর ঢুকলে
লেপা উঠানের পাশে বিব্রত নারীর কণ্ঠনালিতে
একশো একটা লালচে সূর্যের দাগ।
গোবর লেপানো উঠানের পাশে
মা মাত্রই একশো একটা পেঁপেগাছের ছায়া ।