রবিশংকর বল >> হঠাৎই দোজখনামাকে খুঁজে পেয়েছিলাম । অমর মিত্র >> দোজখনামার কথা
প্রকাশঃ December 14, 2017

রবিশংকর বল >> হঠাৎই দোজখনামাকে খুঁজে পেয়েছিলাম
যে কোনো বাঙালি ঔপন্যাসিককে উপন্যাস লিখতে হলে বঙ্কিমচন্দ্রকে কনসাল্ট না করে লেখা যায় না। বঙ্কিমচন্দ্র সম্পর্কে যা যা বলা হয়ে গেল, একটু আগেই কমলদা রোহিণীর কথা বলেছিলেন, আমার মাঝে মাঝে ওই ছবিটা ভেসে ওঠে, “রোহিণীর জল তল জল আলো করিয়াছিল…” ভাবা যায় না। বঙ্কিমচন্দ্ৰ আমার মজ্জায় মজ্জায় জড়িয়ে আছেন। ২০০৫ সাল থেকে আমার উপন্যাস লেখা বদলাতে শুরু করি। তার আগে পর্যন্ত ইউরোপীয় আধুনিকতার ঘরানাটা, যেখানে একজন ইনডিভিজুয়াল আছেন, সেই ইনডিভিজুয়ালের ক্রাইসিস—এই জায়গা থেকেই উপন্যাস লিখতে থাকি। ২০০৫ সালে হঠাৎ আমার মা আমাকে দুটি খাতা দিয়ে বললেন, আমি একটা লেখা লিখেছি, আমার আত্মজীবনী, নাম ‘খোলা খাঁচা বন্দী পাখী।’ কী করে নামটা দিলেন জানিনা, মা শিক্ষিত মহিলা নন, লেখাপড়া বেশি করেননি, গল্প-উপন্যাস পড়তে ভালোবাসেন। আত্মজীবনী যে পড়তে দিলেন, তার মধ্যে ভাগ নেই, ক্রম নেই। বললেন, তুই এটা পড়। তার মধ্যে কিছু এলেমেলো লেখা আছে, ছাপার জন্য দেওয়া যেতে পারে। আমি পড়তে পড়তে তার জীবনের ঘটনাগুলি জানতে পারলাম এবং দেখলাম যে তিনি কাহিনি করতে চাননি, জীবনের কথা বলতে চেয়েছিলেন, েযেটা অজান্তেই তৈরি হয়ে গেছে। এই সময়েই আমি একজন সাহিত্যিককে আবিষ্কার করলাম, তাঁর নাম মেহের মাসুদ। তিনি লখনউতে থাকতেন, পড়াতেন, তিনি কখনও ভারতের বাইরে যাননি। বিরাট মহলে তিনি থাকতেন। মার যে আত্মজীবনী পডছিলাম তার সঙ্গে ওর ওই ন্যারেটিভটার কোথায় যেন মিল আছে। ওই ন্যারেটিভটাতে একের পর এক গল্প আসছে, একের পর এক চরিত্র আসছে, আবার সেই চরিত্র হারিয়েও যাচ্ছে; আমি তারপর একটি উপন্যাস লিখতে শুরু করলাম, ছায়া পুতুলের খেলা। যখন লিখতে শুরু করছি তখন থেকে আমার ইসলামিক সংস্কৃতির প্রতি একটা আগ্রহ হতে শুরু করেছে। তার যে বড়ো সম্পদ সেটা আমি বুঝতে পারছি, ধরতে পারছি, আমার খুব খারাপ লাগছে যে আমি কেন এতদিন জানিনি। এত বড়ো একটা সংস্কৃতির মধ্যে রয়েছি, আমি কেন জানিনি, ছায়া পুতুলের খেলায় একটা চ্যাপ্টার আছে যেটাতে রেজাক আলি একটা চিঠি লিখছে। ছায়া পুতুলের খেলা থেকে আমার ন্যারেশনের পদ্ধতিটা বদলাতে শুরু করল। তারপরে আমি দোজখানামা উপন্যাস লিখলাম, এবং দোজখনামার আগে কোনো ঐতিহাসিক উপন্যাস লিখিনি, এটা আমি বারবার বলেছি। আর এই সূত্রে, একটু বলি, দোজখনামা কী করে লেখা হল। ২০০৬-এ ছায়া পুতুলের খেলা লেখার সময় থেকেই মির্জা গালিবকে নিয়ে উপন্যাস লেখার ভাবনা। ছায়া পুতুলের একটি অধ্যায়ও মির্জার বয়ানে লেখা একটি চিঠি। এই সময় থেকেই মির্জা গালিব, তাঁর আখড়া নিয়ে পড়াশুনা শুরু হয়, আর চলতে থাকে উর্দু কাব্য ও কাহিনি, স্মৃতি-সাহিত্যের সঙ্গে বসবাস। মির্জার ভিতরে ঢোকার মহড়া হিসেবে দুটি গল্প লিখি। অনেকগুলো ডায়ালগ গড়ে উঠতে থাকে। লেখা হয় উপন্যাস লেখার দু-একটি খসড়া, প্রতিবারই তা ভরে উঠতে থাকে। মির্জা নিয়ে আমি কোনো ঐতিহাসিক উপন্যাস লিখতে যদি চাইতাম তার কোনো অসুবিধা হত না, কারণ সাল তারিখ মিলিয়ে তাঁর জীবন ও সময় লিখে ফেলা যেত। কিন্তু আমি তো ওভাবে চাইনি উপন্যাস লিখতে। উপন্যাস খোঁজে নানা ব্যক্তিকে, খোঁজে তাদের জীবন ও কণ্ঠস্বর। এই উপন্যাস সমসাময়িক হতে পারে, ইতিহাসের চরিত্র হতে পারে। কোনো ব্যক্তিকে না আনতে পারলে উপন্যাস লেখা ব্যর্থ। এখানে সে ইতিহাসের থেকে অন্য পথে হাঁটে। ঐতিহাসিক অশীন দাশগুপ্ত ‘ইতিহাস সাহিত্য’ বক্তৃতায় বিষয়টি স্পষ্ট করে বলেছিলেন,“ইতিহাস মানুষের, কিন্তু ঐতিহাসিক মানুষের ভিতর প্রবেশ করতে পারেন না। সাহিত্য চিরকালই যে কাজটি করেছে, এখনও করে, সাহিত্য হচ্ছে সত্যের প্রকাশ, আর ঐতিহাসিকদের কাছে তা ঈর্ষার বস্তু।” তলস্তয়ের ওয়ার অ্যান্ড পিস থেকে কথা বলতে বলতে অশীনবাবু জানান, ঐতিহাসিক যেহেতু তথ্যনিষ্ঠায় বন্দি, তলস্তয়ের পটোগ্রাফকে গ্রহণ করা তার পক্ষে অসাধ্য। তলস্তয় এই ভুল করবেন কেন? তার কারণ, তাঁর সাহিত্য রচনায় এই ভুলের প্রয়োজন ছিল। তাই ঐতিহাসিকের চোখে দেখা মির্জা গালিবের সঙ্গে দোজখনমার গালিব অনেক ক্ষেত্রে মিলবে না। ইতিহাসগতভাবে মির্জার সঙ্গে কবির শাহ, রামনিধি গুপ্তর দেখা হতে পারেনা। তিনি রবীন্দ্রনাথ বা শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতার বই কী বলতে পারেন না। দোজখনামায় এমনটাই ঘটে। অশীনবাবুর কথায় আবার ফিরে যাই, “সাহিত্যে সময়ের ব্যবহার এবং ঘটনার বর্ণনায় সাহিত্যিকের বিশেষ অধিকার। এই বিশেষ অধিকার কী, অল্প কথায় বললে, এই দাঁড়ায়, যে ঘটনার উপস্থাপনায় সাহিত্যিক স্ৰষ্টা হতে পারেন, আবার নিজেকে নিছক দর্শক হিসেবেও রাখতে পারেন। ঐতিহাসিক শুধুই দর্শক।” আর ঔপন্যাসিক শুধুই দর্শক নন, তিনি স্ৰষ্টাও।
কিন্তু মির্জা গালিবের ব্যক্তিত্বের মধ্যেই কেন ঢুকতে চাইলাম, মির্জার জীবনের কথা জানতে জানতে যে অপ্রতিরোধ্য টান তাঁর প্রতি জন্মাল, তার কোনো ব্যাখ্যা নেই। হয়তো মির্জার আয়নায় নিজেকেই দেখতে পাচ্ছিলাম, এছাড়া তো এমন ভালোবাসা জন্মায় না। মির্জা একটি শেরে লিখেছিলেন, দয়া করে যখন খুশি আমাকে ডেকে নাও, আমি বিগত সময় নিজে আবার আসতে পারব। তাই তো মির্জাকে আবার ডাকতে পারলাম, তাকে আমার সমসাময়িক মনে হচ্ছিল। পাপ, পতন, দারিদ্র্য, নির্য়াতন কবিতার জন্য উড়াল এবং এর মধ্যে আমরা কি বেঁচে থাকিনি? বাহাদূর শাহর দরবারে মির্জা যেভবে অপমানিত হয়েছেন, এই সময়ে নানা দরবারে আমিও কি অপমানিত হইনি? পুরোনো দিল্লি ১৮৫৭র পর যেভাবে তাঁর চোখের সামনে থেকে মুছে গেল, আমিও কি ’৭০-’৮০র কলকাতাকে মুছে যেতে দেখছি না?
ব্যক্তিক মির্জাকে খোঁজার পাশাপাশি আরও একটা আকর্ষণ ছিল। বুঝতে চাইছিলাম ইসলামিক সংস্কৃতিকে সেই মানুষজনদের যাদের পাশাপাশি শতাব্দীর পর শতাব্দী বেঁচে থেকেও আমরা তাদের বুঝতে চাইনি। কিছুই জানি না তাদের সম্পর্কে। উপন্যাস লিখতে গিয়ে আমি আলাদা হয়েছি। হয়তো কিছু জানার জন্য আমার মুসলিম বন্ধুদের ফোন করেছি, আমাকে তারা কোনোভাবে সাহায্য করতে পারেনি। নিজেদের কথাও তাঁরা জানেন না। দোজখনামার অন্তর্গত রাজনীতির যেখানে এই রচনা, পাশাপাশি বেঁচে থাকা, অথচ অপর বলে তার সংস্কৃতিকে বুঝতে চেয়েছি। এই উপন্যাস লেখার সূত্রে আমি এক বিশাল ট্র্যানজিকে জানতে পেরেছি।
এবার সাদাত হাসান মান্টের কথায় আসা যাক। কেন কীভাবে তিনি এই উপন্যাসে ঢুকে পড়লেন? গালিবকে নিয়ে উপন্যাস ভাবনায় মান্টো কোনো কারণেই ছিলেন না উপন্যাসের প্রাথমিক খসড়ার ভিতর। আমি একদিন মান্টোর জীবনী পড়তে পড়তে জানতে পারি মির্জা গালিব তাঁর প্রিয় কবি, গালিবকে নিয়ে তিনি ছবির চিত্রনাট্য লিখেছিলেন। সেই ছবিতে অভিনয় করেন ভারতভূষণ ও সুরাইয়া দেবী। মান্টো সাব পাকিস্তানে চলে যাবার পর ছবিটি মুক্তি পেয়েছিল। যেভাবে জানি সেভাবে মান্টো আমাকে প্ৰাণ-ভালোবাসায় জড়িয়ে নিয়েছিলেন, দুটি চরিত্র যেন মুখোমুখি দুটি ভাইয়ের মতো। আমিও উপন্যাসের ধরতাইটা পেয়ে গেলাম। আচ্ছা এমন কী হতে পারে, মান্টো সাব একটা উপন্যাস লিখছিলেন মির্জাকে নিয়ে, তাহলে কীভাবে লিখবেন? বয়ানটা কী হবে? উপন্যাসের প্রাথমিক খসড়া থেকে মির্জা কথা বলেছিলেন কবর থেকে। এবার জুড়ে বসলেন মান্টো সাব। তাহলে ভারত ও পাকিস্তানের কবরে শুয়ে দুজনে দুজনের সঙ্গে কথা বলবেন। আমি শুধু তাদের সংলাপ লিখে যাব। মান্টো সাব এসে কথন ঢুকে পড়লেন, প্রেক্ষাপটটা আরও ছড়িয়ে গেল। চমক ছড়িয়ে পড়ল উপন্যাসে। শুধু মির্জা আর মান্টো সাবই নয়। আরও কত চরিত্র কড়া নাড়ত এই লিপিকরের দরজায়। ওদের কাউকেই আমি দেখিনি। কিন্তু অনুভব করেছি। বুঝতে পেরেছি। তারা না থাকলে মির্জ-মান্টো কিসসার কোনো অর্থ নেই। তারা কেউ মির্জার সময়ে দিল্লির মানুষ, কেউ মান্টো সাবের সময়ে পাঞ্জাব-দিল্লি-লাহোরের মানুষ, কেউবা সদা কিসসা চরিত্র, সুফি টাইপের মানুষজন, সেলিমউদ্দিন আখতারের কাব্যকাহিনির পাখিরা উপন্যাস লিখতে এইসব চরিত্রকে খুঁজে পেয়েছি। আর ততই বিশ্বাস অর্পিত হয়েছে খোদার উপর, যিনি এত অচেনা মানুষকে চিনিয়ে দিলেন।
আমার জীবনের একটি পর্বের কথা এখানে বলব। এই পর্বটি না এলে বোধহয় মির্জাকে চিনতে পারতাম না। পত্রিকায় তিন-চারটে অধ্যায় বেরিয়ে গেছে, নানাভাবে ধ্বস্ত ও অ্যালকোহলের শিকারে আমাকে ভরতি হতে হল এক হাসপাতালে, যেখানে নেশা ছাড়ানোর চিকিৎসা হয়। নেশার মধ্যে থাকতে থাকতে আমি আবিষ্কার করলাম এমন এক জগৎ যার একচুল তফাতে দাঁড়িয়ে আছে একজন শিল্পীর জীবন। মির্জা বা মান্টো সাব। চিকিৎসালয়ে আমার সঙ্গে ছিল মির্জার চিঠির সংগ্ৰহ। চারপাশের মানুষগুলোকে দেখছি, মির্জার চিঠি পড়ছি, দৃষ্টিপ্রদীপে আমি অনুভব করলাম এবার মির্জা বা মান্টো সাবের বুকে আমি হাত রাখতে পারব। এই কয়েকটি দিন আমার জীবনে না এলে, আমি মির্জার বন্দিত্বকে অনুভব করতে পারতাম না, মান্টো সাবের ভয় বুঝতে পারতাম না। দোজখনামা বই হয়ে প্রকাশিত হল ২০১০-এর শেষে। আর ওই বছরেই আমি প্রথম দিল্লি গিয়ে জামা মসজিদ দেখলাম, মির্জার হাভেলির সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। গালিব অ্যাকাডেমিতে মির্জার নাম লিখে দোজখনমা দিয়ে এলাম। জামা মসজিদে বসে আমার মনে হচ্ছিল দোজখনামা আসলে লিখে দিয়ে গেছেন অনামা এক দুস্তান্তক। এই উপন্যাস আধুনিক কি অনাধুনিক, চেতনাপ্রবাহমূলক কি তা নয়- এসব প্রশ্ন অবান্তর। হয়তো এটা উপন্যাসই নয়। আমি কিছুই দাবি করি না, অনেকেই অনেক কিছুর খোঁজ করেন। আমি খুঁজি। হঠাৎই দোজখনামাকে কুড়িয়ে পেয়েছিলাম। প্রত্যন্ত জগতে আকাশ থেকে খসে পড়া এক উল্কাখণ্ডের মতো।
সূত্র : বাংলা বই, জানুয়ারি ২০১৪
অমর মিত্র >> দোজখনামার কথা
দোজখনামা উপন্যাসটি দেশভাগের। দোজখনামা সাদাত হোসেন মান্টোর জীবন। মহাকবি গালিবের জীবন।
মহাবিদ্রোহ, পরাজয়ের পর এদেশের মানুষের পাকাপাকিভাবে পরাধীনতায় প্রবেশ। দোজখনামা এক বেহেস্তের দোজখ হয়ে যাওয়ার কাহিনি। দোজখ থেকে বেহেস্তের কল্পনা। এই উপন্যাসটির বহু মাত্রা আছে। আর বহুমাত্রার জন্য এই উপন্যাস কখনোই মনের ভিতরে গিয়ে শেষ হয়ে যায় না। দোজখনমা আমি পড়েছি বছর তিন আগে, গ্রন্থাকারে প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে। কোনো-কোনো পাঠ হয়ে ওঠে। ধারাস্নান। সেই ধারাস্নানের অভিজ্ঞতা এখনও মিলিয়ে যায়নি। দোজখনামা নিয়ে ধারাস্নানের সেই অভিজ্ঞতার কথাই আবার বলতে বসেছি।
আসলে উপন্যাস কতরকমে লেখা হতে পারে সেই কথাটি মনে করতে চেষ্টা করি। কেউ কেউ উপন্যাসের রসদ জোগাড়ে স্থান থেকে স্থানান্তরে যাত্রা করেন। সবকিছু আগেই ঠিক করে নেন। জলঙ্গীর বন্যা নিয়ে লিখবেন কি বীরভূমের কোনো এক জনগোষ্ঠী নিয়ে লিখবেন। তথ্যই সেই লেখার মূল আধার। তথ্য জানায় ভুল থেকে গেলে, সেই ভুলই উপন্যাসে চলে আসে। আর কেউ কেউ লেখেন জীবনযাপনের অভিজ্ঞতা নিয়ে। আর যাপিত জীবনে থাকে কতরকম অভিজ্ঞতা। পাঠ অভিজ্ঞতা তার ভিতরে প্রধান। প্রধান হয়ে আসে কল্পনা। রবিশংকর বলের দোজখনামা দ্বিতীয় গোত্রের উপন্যাস। তিনি কী আশ্চর্য এক কল্পনার দুয়ার খুলেছেন ক্ৰমান্বয়ে, এই উপন্যাসের পরিচ্ছেদে পরিচ্ছেদে। এই উপন্যাসের দুই প্রধান চরিত্র, মহাকবি গালিব এবং মহালেখক মান্টো ভারত ও পাকিস্তানের মাটির নীচে, কবরে শুয়ে আছেন। তারা যেন মাতৃগর্ভের অন্ধকারে শুয়ে পরস্পরে আলাপ করেন। দিল্লি আর লাহোরে শুয়ে গালিবের সঙ্গে কথা হয় মান্টোর। সেই কথোপকথনের ভিতর দিয়েই উপন্যাসের বিস্তার। এই আশ্চর্য কিসসা লেখা হয়। কিসসা তো এই দুনিয়ায়। এই জল মাটি আর পৃথিবীর, উপরওয়ালার। গালিব বলছেন তাঁর বান্দা কাল্লুর কথা। তখন ১৮৫৭-র বিদ্রোহ শেষ। তারপর আরো ১২ বছর বেঁচেছিলেন তিনি। কিন্তু চুপ করে থাকতেন জীবন সায়াহ্নে এসে। ভাঙাচোরা দিবানখানায় শুধু শুয়ে থাকতেন, কাল্লু এসে একটু পরোটা, কাবাব বা ভুনা গোস্ত আর দারু দিয়ে যেত। কাল্লু খুব ভালো কিসসা বলত। জামা মসজিদের চাতালে বসা দস্তানগোর পাশে বসে কিসসা শুনত। সেই কিসসা সে বলে বেড়াত। দস্তানগোরদের কাজই ছিল মানুষকে কিসসা শুনিয়ে রোজগার করা। এই উপন্যাসে রবিশংকর বলা হলেন দস্তানগো। এই উপন্যাস একটি দস্তান। কিসসা। সেই কিসসা কে লিখছেন এখানে ? মান্টো বলছেন তিনি লিখছেন না তাঁর ভূত? মান্টো তাঁর সমস্ত জীবন একটি মানুষের সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছেন, মির্জা মহম্মদ আসাদুল্লা খান গালিব। মান্টোর মনে হয়েছে মির্জা আর তিনি যেন মুখোমুখি দুটি আয়না। দুই আয়নার ভিতরেই শূন্যতা। দুই শূন্যতা একে অপরের দিকে তাকিয়ে বসে আছে।
কিসসায় এক কাহিনির সঙ্গে আর এক কাহিনি জুড়ে যায়। তার কোনো শেষ নেই। এই উপন্যাস আরম্ভ হয় লখনউ-এর ওয়াজিরগঞ্জে এক কিসসা লেখক ফরিদ মিঞার মুখে মুখে। লেখক লখনউ গিয়ে ফরিদ মিঞার সঙ্গে দেখা করেন নানা সূত্রে তাঁর কথা জানতে পেরে। তিনি লখনউ গিয়েছিলেন তবায়েফদের নিয়ে একটি লেখার খোঁজে। লিখেই তাঁর দিন চলে, তিনি তো যাবেনই লেখার খোঁজে। ফরিদ মিঞা হলেন এক কিসসা লিখিয়ে। লিখতেন, কিন্তু ছেড়ে দিয়েছেন লেখা কেন না কিসসা লিখিয়েকে বড়ো একা হয়ে যেতে হয়। তার জীবন কারবালা হয়ে যায়। ছায়া ছায়া মানুষের সঙ্গে কাটাতে হয় জীবন। সেই ফরিদ মিঞা এই দস্তানের কথক বা দস্তানগোর হাতে তুলে দেয় নীল মখমলে মোড়া একটি পাণ্ডুলিপির পুঁটুলি, উর্দুতে লেখা একটি উপন্যাস, লিখে গেছেন সাদাত হোসেন মান্টো। মান্টোর লেখা এই অলীক উপন্যাস মির্জা গালিবকে নিয়ে। কথক উর্দু জানেন না, কিন্তু ফরিদ মিঞা তাকে দিয়েছে পাণ্ডুলিপি অনুবাদ করে প্রকাশের জন্য। তিনি কলকাতায় ফিরে উর্দু শিখতে যান। তবসুমের কাছে। তবসুমের কাছেই জানে উপন্যাসে একটি ভূমিকা আছে মান্টোর, ১৮ই জানুয়ারি, ১৯৫৫ সেই ভূমিকা লিখনের তারিখ, যে তারিখে ইন্তেকাল হয়েছিল মান্টোর। তখন তিনি লেখার অবস্থায় ছিলেন না। রোগজর্জর হয়েই পাকিস্তানে মারা গিয়েছিলেন মান্টো। সেই উপন্যাসই বুঝি এই দোজখনামা। দোজখের কিসসা। রবিশংকর বল এই আশ্চর্য উপন্যাস লিখেছেন এক বিচিত্র আঙ্গিকে। আসলে যে কোনো আখ্যানের মূল শক্তি তার লিখন ভঙ্গি, লিখন প্রক্রিয়া, আঙ্গিক। রবি লিখবেন গালিবের জীবন বা মান্টোর জীবন। তিনি তার কথন ভঙ্গিতেই আমাকে নিয়ে গেছেন ফরিদ মিঞা বা তার চারপাশে ঘোরা ছায়া ছায়া মানুষের ভিতর। মান্টো আরম্ভ করেন আলাপ| গালিবের পূর্ব-পুরুষকে স্মরণ করেন। একটি ধুলোর ঝড়। অশ্বারোহীরা নদী পেরিয়ে আসছে সমরখন্দ থেকে। সূর্যের আলোয় ঝলসাচ্ছে তাদের ঘুরন্ত তরবারি। হত্যা আর রক্তের কারবালা পেরিয়ে তারা আসছে ভারতবর্ষের দিকে। নিজে কোনোদিন তরবারি স্পর্শ করেননি মির্জা গালিব, কিন্তু তাঁর পূর্বপুরুষ ছিল তুর্কি সৈনিক। বিভক্ত হয়ে যাওয়া দেশের পশ্চিম পাকিস্তানের শহর লাহোরের মাটির নীচে শুয়ে মান্টো এইভাবে শুরু করেন গালিবের কথা। মান্টো পাকিস্তানে যাওয়ার আগে বোম্বে টকিজের গালিবকে নিয়ে তৈরি একটি সিনেমার চিত্ৰনাট্য লিখেছিলেন। সেই সিনেমা রিলিজ যখন করে, মান্টো ওপারে। গালিব এবং মান্টো দুই মহাপ্রতিভাধরের জীবন এই উপন্যাস। মান্টোর সঙ্গে আলাপে গালিব নিজের জীবনের কথা স্বপ্নের কথা, ধুলো হয়ে যেতে থাকা জীবনের কথা শোনান। মান্টোও তাই। এই দুই প্রতিভাধরের জীবনের সঙ্গে যেন এই উপমহাদেশের ইতিহাস জড়িয়ে গেছে। ১৮৫৭-র সিপাহী বিদ্রোহ, মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের শব্দ, আর ১৯৪৭-এর স্বাধীনতা, দাঙ্গা রক্তপাতে কারবালা হয়ে যাওয়া এই উপমহাদেশ, দুই সময়ের সাক্ষী দুই নিয়তিতাড়িত মানুষ। এই উপন্যাস ইতিহাসের দুই সন্ধিক্ষণের ভিতর যেন সেতু নির্মাণ করেছে। অতীত থেকে ভবিষ্যতকে দেখা। বর্তমান থেকে অতীতে ফিরে তাকানো। মান্টোর জীবনকথা রচনা করতে তার গল্পের আশ্রয়েও গেছেন লেখক, আর সেই যাওয়া হয়েছে তাঁর রচনার গুণে এতই নিবিড় যে মনে হয় মান্টোর জীবনে এই পরাবাস্তবতা জড়িয়ে গিয়েছিল। গিয়েছিল তো নিশ্চিত, এই দস্তানে তো ধরা আছে মান্টো আর গালিবের আত্মার ক্ৰন্দন। সে ক্ৰন্দনধ্বনিই এই আখ্যানের মূল সুর। ক্ৰন্দন মানবাত্মার পচনে, মানুষের ক্রমাগত নিষ্ঠুরতায়। মান্টো আর গালিব, দুই কালের দুই প্রতিভাধর সেই নিষ্ঠুরতার সাক্ষী। লেখক আমাদের ইতিহাসকে চিনিয়ে দিয়েছেন এই দস্তানগো তীব্র দস্তানের পুটুলি খুলে। কিসসার পর কিসসা শুনিয়ে গিয়েছেন আমাদের। সেই কিসসায় এই উপমহাদেশের পরাধীনতা, এই উপমহাদেশের রক্তপ্লাবিত স্বাধীনতা। তারই ভিতরে অতিবাহিত হয়েছিল গালিব ও মান্টোর জীবন। সেই জীবনের কথা রচনা করতে গিয়ে লেখক যেমন ইতিহাসের সত্যকে খুঁজতে গিয়ে প্রবেশ করেছেন, মান্টোর জীবনের যতটা জানা যায় তারও বেশি কিছুতে। বেশিটুকু এসেছে মান্টোর কোনো কোনো গল্প থেকে। সাহিত্যের সত্য থেকে তিনি হেঁটেছেন জীবনের সত্যে। কী অপূর্ব এই যাওয়া। রবিশংকর বল তাঁর এই উপন্যাস শুরুই করেন হারিয়ে যাওয়া, মুছে যাওয়া সময়ের দুয়ারে দাঁড়িয়ে৷ সময় থেকে সময়ান্তরে গেছেন, ফিরে এসেছেন। সে যেমন মান্টো আর গালিবে…একশো বছরের ভিতরে যাওয়া আসা, তারও পিছনে যাওয়া আবার ফিরে আসা। ক্ষয়ে যাওয়া মোগল যুগের পদশব্দ শোনা যায় এই উপন্যাসে। অভিনব হল এই দস্তানের পুঁটুলির এক একটি গিট খুলে ফেলা। দস্তান উন্মোচনের পর দস্তানগো তাঁর ঝোলা থেকে একের পর এক কাঠের পুতুল বের করে মসজিদের চত্বরে সাজিয়ে দিতে থাকে। লেখক বলেছেন, সবই যেন তার এই উপন্যাসের চরিত্র। সবকটি পুতুল ঝলমলে। ইতিহাসের ধুলোবালিতে তারা মলিন হয়ে যায়নি। মনে হয়েছে সেই ধুলো উড়িয়ে দিয়েছেন এই দস্তানের দস্তানগো। প্রথাগতভাবে উপন্যাস লেখেন না রবিশংকর। সাহিত্যের পাঠক হিসেবে তীর প্রথাভাঙার ভিতরে আমি যুক্তিগ্রাহ্যতা দেখতে পাই। তার উপন্যাস বাস্তবতার দাসত্ব করে না। তা পেরিয়ে তিনি পরাবাস্তবতা বলি আর কল্পনার জগৎ বলি সেখানে পৌঁছে যান। সেখানেই তিনি স্বচ্ছন্দ। এই উপন্যাসে কত অলীকদৃশ্য নির্মাণ করেছেন তিনি। ফরিদ মিঞার হাভেলি থেকে তা আরম্ভ হয়। তবসুমের ঘরে উর্দু শিক্ষা থেকে তা ঘনীভূত হয়। তারপর সমস্ত দোজখনামা জুড়ে সেই অলীক দৃশ্যাবলিতে মুগ্ধ হই। উপন্যাসের অস্তিমে এসে লেখক মিঞা তানসেনের জীবনের এক ঘটনার কথা বলেন তবসুমকে। লেখক বলছেন, মির্জা ও মান্টোর জীবন যেন মিঞা তানসেনের গাওয়া দীপক রাগ। অগ্নিদগ্ধ ইতিহাসের এই দুই প্রগাঢ় পিতামহ। মিঞা তানসেনের দগ্ধ শরীর মেঘ রাগে স্নিগ্ধ করেছিল তার পুত্রী সরস্বতী ও তার স্বামী হরিদাসের শিষ্যা রূপবতী। কিন্তু তারা তখন কোথায় যে গালিব ও মান্টোর অগ্নিদগ্ধ দেহকে শীতল করবেন? এই দোজখের জন্য মেঘরাগ কে বাজাবেন?
সূত্র : বাংলা বই জানুয়ারি ২০১৪